মুক্তাগাছার তৈরি বাঁশের ছিপ যাচ্ছে সারাদেশে
সুনামগঞ্জ থেকে ট্রাক ভর্তি করে কিনে আনা হয় ছিপের বাঁশ, এরপর নারীরা সেগুলো থেকে ছোট ডালপালা ছেঁচে সাইজ করেন। তারপর বিশেষ কায়দায় তৈরি চুলার আগুনে এক এক করে বাঁশগুলোতে তাপ দিয়ে রং আনা হয়। একটি নির্দিষ্ট রং ধারণের পর সেটি দিয়ে তৈরি হয় প্রসিদ্ধ ছিপ।
বাঁশ দিয়ে ছিপ তৈরির জন্য ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মানকোন ইউনিয়নের বাদে মাঝিরা গ্রাম প্রসিদ্ধ। এখানকার ছিপের চাহিদাও অনেক। সারা দেশের সৌখিন মাছ শিকারীদের হাতে হাতে যাচ্ছে এখানকার তৈরি ছিপ। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে পাইকাররা তাদের গ্রাম থেকে ট্রাক ভর্তি করে ছিপগুলো কিনে নিয়ে যান। পরে সেগুলো সারা দেশে সরবরাহ করেন।
পূর্বপুরুষদের ছিপ তৈরি করার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বাদে মাঝিরা গ্রামের প্রায় তিনশতাধিক পরিবার। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেনও অনেক নারী-পুরুষ। বেকার যুবকরাও এখন ঝুঁকছেন বাপ-দাদার এ পেশায়।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, শতবছর ধরে এ গ্রামে ছিপ তৈরি চলে আসছে বংশপরম্পরায়। বর্তমানে ঐ গ্রামের পাঁচশতাধিক নারী-পুরুষ ছিপ তৈরি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। মূলত ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চল, কিশোরগঞ্জ থেকে শুরু করে সিলেট অঞ্চল জুড়ে হাওর বেষ্টিত এলাকায় বর্ষার সময়ে বাঁশের ছিপের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আর এ চাহিদার মূল যোগানদাতাই হলো বাদে মাঝিরা গ্রামের এই কারিগররা।
ছিপ তৈরিতে ব্যস্ত কারিগর আব্দুল মাজিদ বলেন, দাদার পর আমার বাবাও ছিপ তৈরির পেশায় জড়ান। ছিপ বিক্রি করে যা আয় হতো, তা দিয়েই সংসার চলত। বাবার কাছে ছিপ তৈরির কৌশল শিখে আমিও এ কাজে জড়িয়ে পড়ি। লাভ যা হচ্ছে তা দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনাসহ পরিবার নিয়ে চলতে পারছি।
আল আমিন নামে অপর কারিগর বলেন, আমাদের এ গ্রামের তৈরি ছিপের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আমাদের কাছে পাইকাররা ছিপ কিনতে আসে।
রুবেল মিয়া নামে আরেকজন কারিগর বলেন, আকারের ভিত্তিতে তিন ধরণের ছিপ তৈরি হয় আমাদের এই গ্রামে। এর মধ্যে বড়টি ৪০, মাঝারিটা ২৫ ও ছোটটি ২০ টাকা ধরে বিক্রি করা হয়। আর ক্রেতাদের বড় অংশই আসেন উত্তরবঙ্গের নানা জায়গা থেকে।
ষাটোর্ধ্ব বয়সী চাঁন মিয়া জানান, বাদে মাঝিরা গ্রামের এলাকাজুড়ে লাখ লাখ ছিপ তৈরি হয়। এখন বন্যার পানি কম থাকায় তুলনাম‚লকভাবে ছিপ কম বিক্রি হচ্ছে। তবে নিয়মিত ছিপ তৈরি করে জমিয়ে রাখা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় একটু বন্যা হলেই ব্যবসা চাঙ্গা হবে। তখন পাইকাররা এ এলাকা থেকে ছিপ কিনতে ভিড় জমাবে।
ছিপ তৈরিতে কেমন খরচ হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছিপের বাঁশঝাড় স্থানীয় কিছু কারিগরদের থাকলেও বেশির ভাগ কারিগর সুনামগঞ্জ থেকে কিনে আনেন। যাতায়াতসহ সবমিলিয়ে প্রতি ছিপে খরচ পড়ে ২৫ টাকা। এরপর সেগুলো বিক্রি করা হয় ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।
তরুণ কারিগর ফরহাদ বলেন, অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া করতে পারিনি। ছোটবেলা থেকেই অন্যের জমিতে কাজ করেছি। আর্থিক সমস্যার কারণে বাঁশ কিনে এনে ছোট পরিসরে ছিপ তৈরির কাজ করছি। এ কাজ করে আমি এখন স্বাবলম্বী। তবে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দিলে ব্যবসা বড় করতে পারতাম। এ জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহসভাপতি শংকর সাহা বলেন, বাংলাদেশে মাছ ধরার ক্ষেত্রে ফিশিং হুইল ক্রমে জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদিত দেশীয় বাঁশের তৈরি ছিপের চাহিদাও ব্যাপক। শৌখিন মাছ শিকারিদের কাছে এই ছিপ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বেকার যুবক আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। পাশাপাশি নারীরাও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন